"আপনার কত সৌভাগ্য, ২১ বছরে কত দেশ ঘুরছেন।"


কবার অধ্যাপক আবু সাঈদ বলেছিলেন তিনি প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের বেশি সম্মান করেন, বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের থেকে। তিনি এখানে তাদেরও যোগ করেছেন যারা পড়তে গিয়ে আর ফিরে আসেননি, বরং পরিবারসহ চলে গিয়েছেন। তার এই বক্তব্যের পর তিনি প্রচুর সমালোচনার ভাগীদার হয়েছেন, এবং তাকে বদ্ধ উম্মাদ বলতেও আমাদের শিক্ষিত শ্রেণীর গায়ে লাগেনি।
মে মাসের ১ তারিখ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত প্রবাসী শ্রমিকরা বাংলাদেশে ৫,২০২ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন। এ ধারা চলতে থাকলে এই মাস শেষে এর পরিমান দাঁড়াবে ২০,০০০ কোটি টাকা। একটা দেশের অর্থনীতি সচল রাখার জন্য এই পরিমান টাকা আসলেই দরকার। বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে তিনটি জিনিসের উপর। প্রবাসীদের বৈদেশিক অর্থ, কৃষি এবং রপ্তানিযোগ্য তৈরি পোশাক। এই তিনটির মধ্যে একটি যদি ভেঙ্গে যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতির সচল চাকা অচল হয়ে যাবে।
ভেবে দেখুন, এই ৩ খাতে যারা কাজ করে যাচ্ছেন, তারা হচ্ছে সবচেয়ে অবহেলিত শ্রেণী। তাদের কাজ দাসপ্রথার মত। অথচ বাংলাদেশ বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদের নিরন্তর প্রচেস্তার বিন্দু মাত্র সম্মান নেই। বরং বাঁচার জন্য এবং বাঁচাবার জন্য সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ৩৭ জন ডুবে গেল, তাতে আমাদের মাথাব্যথা নেই।
আমি কাতার থেকে ফিরছিলাম, তখন পাশের সারির জানালার আসনে একজন মহিলা বসে আছেন। তখন জানালার পাশের আসনের আসল যাত্রী, একজন মেয়ে এসে বললেন এটা আমার সিট। মহিলা সরতে চাচ্ছিলেন না কারন তার বাইরে দেখার শখ অনেক বেশি। আসল যাত্রীও ছাড়বেন না, কারন তিনি ওই আসনটি পেয়েছেন। যাক অবশেষে তিনি আসন ছাড়লেন, আর ওই মেয়েটি তার আসনে বসে কাউকে ফোন দিল এবং ফোনে এই মহিলা যাত্রী সম্পর্কে কটু কথা ইংরেজিতে কিছুক্ষন বলল। আমি তার সবই বুঝলাম কিন্তু এই মহিলা তার কিছুই বোঝেনি, বরং তার ইংরেজি শুনে সে বিস্মিত হল। যিনি কটু কথা বল্লেন, তিনি কানাডাতে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশুনা করছেন, বাবা শিল্পপতি, থাকেন গুলশান, বাংলাদেশে এ লেভেল পর্যন্ত পড়েছেন, ১ বছর পর দেশে ঘুরতে আসছেন। ভাবছেন, আমি এতকিছু জানলাম কিভাবে? ওই নারী বিস্মিত হতে তাকে নানা কিছু জিজ্ঞেস করছিল, আর তার গুন গেয়ে বলছিল, "আপনার কত সৌভাগ্য, ২১ বছরে কত দেশ ঘুরছেন।" আর এই মহিলা সম্পর্কে যদি বলি তিনি জর্ডানে একজন পাচার হয়ে যাওয়া নারী শ্রমিক। যাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন, সে তাকে পাচার করে দিয়েছে। তার একটি বাচ্চা আছে ৫ বছরের, যাকে ১.৫ বছর বয়সে বোনের কাছে রেখে আসেন। এখানে এসে বিভিন্ন বাসা ঘুরে কাজ করে এক বাসায় এখন স্থায়ী হয়েছেন যেখানে তিনি একজন বৃদ্ধ নারীর সেবা ও তার বাসার দেখভাল করেন। তিনি তাকে নিজের মেয়ের মত দেখেন। তার সব বৈধ কাগজ করে দিয়েছেন। ঈদের জন্য বাড়তি টাকা দিয়েছেন, যাত্রার সব খরচ দিচ্ছেন এবং তাকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত নামিয়ে দিয়ে গেছেন। ৩.৫ বছর পর তিনি দেশে যাচ্ছেন। অথচ প্রথম যখন আমি মহিলাকে দেখেছি, আমার একবারের জন্য মনে হয়নি, তিনি একজন শ্রমিক। ভাবছেন, আমি এতকিছু জানলাম কিভাবে? পাশের সিটে থাকা আরেকজন প্রবাসী শ্রমিক তার সাথে কথা বলছিলেন।
কাকে আমার সম্মান করা উচিত? আমার কয়েকবার প্রবাসী বাংলাদেশীদের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। একটাই কথা, "ভাই এতো কষ্ট! কিছু বলার নাই। কিন্তু পরিবার তো চালাইতে হবে। কোনদিন আছে তিনবেলা খাইও নাই। পরিবাররে তো আর না খাওয়াইয়া রাখা যায় না…!" চোখে মুখে তাদের বিষণ্ণতার ছাপ, কিন্তু তার মদ্ধেও আনন্দ আছে কারন তারা নিজের দেশে ফিরছে। অধ্যাপক আবু সাঈদ মনে হয় ভুল কিছু বলেননি...

Comments

Popular posts from this blog

"মানুষ কয়েকশো বছরের মহামারীর ধরন থেকেও শিক্ষা লাভ করতে পারেনি"

চেষ্টা আর সহযোগিতা একে অন্যের পরিপূরক

"To those who can hear me, I say - do not despair"