"মানুষ কয়েকশো বছরের মহামারীর ধরন থেকেও শিক্ষা লাভ করতে পারেনি"


Image Source: Google News


প্রথমেই তাদের প্রতি সম্মান জানালেও সেটা হয়ত খুব কমই হবে যারা নিজেদের মূল্যবান জীবনকে বিবেচনায় না নিয়ে এই কঠিন সময়ে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন । আমি বিশ্বাস করি, তারা আমাদের (বা আমার) চাইতে কয়েক হাজার গুন মহৎ। তারা আছে বলেই মনুষ্যত্ব এখনো আছে।

প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা একসময় ২০ হাজার থেকে ৬০ হাজারে থাকলেও এখন প্রায় এর সংখ্যা ২ লক্ষ এসে পৌঁছেছে। কারন, এর ধরনই হল ছড়িয়ে পড়া।

এরই মাঝে প্রশ্ন উঠেছে জাতি হিসাবে আমরা কতটুকু সচেতন? যদিও সবাই বলছে আমরা সচেতন নই, তার প্রমানও রয়েছে এই হিসেবে যে ছুটি পাওয়ার পরই আমরা পর্যটন এলাকায় ঘুরতে গিয়েছি, আবার সেটি বন্ধ হলে যে যার এলাকায় চলে যাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছি। এতে প্রচণ্ড লোক সমাগম হয়েছে আবার একই সাথে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভবনাও কয়েকগুন বেড়ে গেছে, এবং বেড়েছে। এখানে সঠিক কতজন আক্রান্ত হয়েছেন তার সঠিক নিরূপণ করা না গেলেও, সমগ্র পৃথিবীতে আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটি পেরিয়ে গেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ এই সংখ্যার বাইরে নয়।

দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ তাদের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে ধর্মকে কেন্দ্র করে। মানুষ এখানে অনেকটাই আবেগপ্রবন। সমাজের তাৎক্ষনিক যেকোনো পরিবর্তন এখানে ধর্মের মাধ্যমে করা যায়। কারন, মানুষ এখানে ধর্মকে অন্ধের মত বিশ্বাস করে, সচেতন ভাবে নয়। আসলে মানুষ সচেতন ভাবে জানার সুযোগই পায় নি। বেশিরভাগ মানুষ ধর্ম, গ্রন্থ থেকে শেখেনি, শিখেছে লোকমুখে আর যুগের চর্চায়। ফলাফল হল অন্ধবিশ্বাস বা যে যা বলছে তাই মেনে নেওয়া। তাই এক কালে এখানে সতীদাহ প্রথাও মাথা উঁচু করে ছিল। আবার এখন যেমনঃ করোনা ভাইরাসের ওষুধ গোমূত্র, স্বপ্নে পাওয়া থানকুনি পাতা খাওয়া, সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চার চা পানের বয়ান দিয়ে যাওয়া, হঠাৎ করে মাঝরাতে নামাজ ছাড়া আযান দেয়া আরও অনেক কিছু হয়েছে। মানুষ এগুলো করছে বলে আফসোস নেই কারন, মানুষ এখানে অসচেতন তার ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে। আর পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে ধর্মের তেমন একটা বালাই নেই। অন্যদিকে, ধর্মীয়ভাবে একত্রিত হওয়া যেখানে নিয়ম এবং প্রতিদিনের অভ্যাস, সেখানে খানিকটা ছেদ পড়লে মানুষ এর বিরোধিতা করবে এটা স্বাভাবিক। কারন, সে তার অভ্যাসের বাইরে যাচ্ছে। সিগারেট যেমন একদিনে ছাড়া যায় না, এখানেও বিষয়টা তাই। আর ধর্মের ব্যপারে বিষয়টা আরও স্পর্শকাতর। তাই এখন এই পরিবর্তন আনতে সচেতনতার চেয়ে সময় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য জাতিকে গালাগাল দেয়ার কোন কারন দেখি না।

যেসব দেশকে আমরা স্বপ্নের দেশ হিসেবে বিবেচনা করি, কথায় কথায় যাদের আমরা সচেতন জাতি বলে আখ্যা দিয়ে নিজেকে অসেচেতন জাতি হিসেবে গণ্য করি, তাদের পরিস্থিতি দেখে তাদের সচেতনতার দৌড় কতটুকু এটা ভালোভাবেই নিরূপণ করা যায়। অন্যদিকে, আমরা এটাও দেখেছি যে, উন্নত দেশগুলো সামান্য টিস্যু পেপার কেনা নিয়েও নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছে। বস্তুত, কিছু মানুষের অসচেতনতা বা তাদের কার্যকলাপ দেখিয়ে সমস্ত জাতিকে অসচেতন বলার কোন কারন আমি দেখি না। একই রকম ভাবে সেটা বাকী জাতিগুলোর জন্যও সত্য। সমগ্র মানবজাতিই তার অসতেনতার অভ্যাসের কারনেই এই পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছে।

বিল গেটস ২০১৫ সালের কোন একটি সময়ে বলেছিলেন যে আমরা সে পরিমান টাকা অস্ত্র ও মেশিন তৈরিতে বিনিয়োগ করি তার ছিটেফোঁটাও রোগ নিয়ন্ত্রনে ব্যয় করি না। অবশ্যই তার কথা সত্য কারন, যুগে যুগের যুদ্ধ মানুষকে ঘরবন্দি করতে পারেনি, অর্থনীতিতে প্রভাব ফেললেও চাকা ভাংতে পারেনি। অথচ, একটি ভাইরাস পৃথিবীকে থমকে দিয়েছে। মানুষ কয়েকশো বছরের মহামারীর ধরন থেকেও শিক্ষা লাভ করতে পারেনি। আসলে সে শিক্ষা নেয়নি। মহামারীর আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও মানুষ অসচেতনতারই পরিচয় দিয়েছে।

এই মহামারীর শেষ কোথায়, বলাটা কঠিন। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ আদতে থেমে আছে। সবাই বন্দি জীবন যাপন করলেও এখন বেরিয়ে আসছে। বন্দি অবস্থায় থেকে কর্মমুখী মানুষের মানসিকতায় বিরূপ প্রভাবও পড়ছে। অনুন্নত দেশগুলো দুর্ভিক্ষ সমস্যায় পড়বে। কাতারে কাতারে মানুষ মরবে না খেয়ে, কারো কিছুই করার থাকবে না।

দুর্ভিক্ষ উন্নত দেশগুলোর চিন্তার কারন না হলেও অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য আরেকটি মহামারী। এইদেশই তার সম্মুখীন হয়েছে। কারন, একটি গবেষণায় বলা হয়েছিল প্রায় ৯ লক্ষ লোক কর্মহীন হয়ে পড়বে, কারন তারা যেখানে কর্মরত সেসব প্রতিষ্ঠান আর দাঁড়াতে পারবে না। এটি অনেক অংশেই বাস্তব হয়েছে সময়ের পরিক্রমায়। মানুষ চাকরি হারিয়ে শহর ছেড়েছে। অন্যান্য দেশেও তাই হয়েছে। অল্প আয়ের মানুষ না খেতে পেয়ে আগে মরে গেলেও কেউ তাদের মুখে খাবার তুলে দেবে না। কারন, মানুষ বৈষম্য তৈরি করেছে নিজের জন্যই। পৃথিবীর সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেকের বেশি ১% মানুষের হাতে জমা হয়ে আছে। এখানে কখনই মানুষ নিচুশ্রেণিকে উঠে দাঁড়াতে দেয়নি। ভবিষ্যতেও দেবে না। এটাই অভ্যাস। আমরা কত প্রযুক্তি তৈরি করছি কিন্তু কোন প্রযুক্তিই অল্প আয়ের মানুষের জন্য নয়। বরং বেশিরভাগ প্রযুক্তিই তাদের আরও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অথচ, এই শ্রেণী যদি না বেঁচে থাকে, তাহলে সবাই যে দুর্ভিক্ষে মারা যাবে এটা কেউ বুঝতে চায় না। হায়, এখনেও মানুষ অসচেতনতার পরিচয় দিচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে আমি-আপনি কি করেছি?

১. নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি, কোন কিছুতে তেমন কান দেইনি হয়ত।

২. নিজের পরিবারকে নিয়ে ঘরোয়া কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থেকেছি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও করেছি।

৩. ঘুম, গেম খেলা, মহামারীর সিনেমা দেখা দেখা ছিল সাধারন কর্মকাণ্ড (কোন শিক্ষা না নিয়ে)

৪. ভিডিও কল করার মাধ্যমে আড্ডা দিয়েছি।

৫. সমাজসেবামূলক কাজে এগিয়ে এসেছি।

৬. নিজে যেতে না পারলেও সেবামুলক কাজে অংশগ্রহন করেছি।

৭. সারাদিন নিজে হাতে স্যানিটাইজার মেখে বলেছি, আপনিও সচেতন হন।

৮. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘণ্টায় ঘণ্টায় নিজের কর্মকাণ্ডের পোস্ট দিয়েছি, লাইক দিয়েছি।

৯. সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছি সবার জন্য, যারা আক্রান্ত, যারা দুঃস্থ, আর যারা নিয়মিত তাদের সেবা করে যাচ্ছেন।

১০. মানুষকে নিয়ে ভেবেছি কিনা যে তাদের সব সমস্যার সমাধান কিভাবে করা সম্ভব, সেটা বলা কঠিন। মানবিক গুণ হয়ত বেড়েছে।

আরও অনেক কিছু। কি করেছেন সেটা আপনিই ভালো জানেন। আমি ভেবে দেখলাম, ১০ নম্বরটি করা সবচেয়ে কষ্টের কাজ। কারন, আমি তাদের সমস্যা আমার জায়গায় থেকে পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করতে পারি না। আমি একা বৈষম্য ভাঙতে চাইলেও পারব না যদি অন্যরা না চায়। হয়ত, সেটা হবেও না। আর মানবিক গুণ গড়ে নিজের মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করা একটি বই পড়ে শেষ করার মতন তো নয়ই। আমার, একবার জাপান যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আমি তাদের মানবিক গুণগুলো দেখে সত্যিই বিমোহিত হয়ে পড়েছিলাম। জানতে পারলাম, তারা একবার ছোট বয়স থেকে এই গুণের চর্চা করে। আমার দেখা মতে তারাই সেরা (ভুলও হতে পারে)। আমাদের ও এককালে এই চর্চা করার সুযোগ ছিল। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। আমরা স্বশিক্ষিত হয়ে সুশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলার চাইতে শুধু শিক্ষিত হওয়ার দিকে বেশি নজর দিয়েছি। গোটা বিশ্বও তাই করেছে। বিশেষ করে আমাদের মধ্যে আমরা অতি শিক্ষিত হয়েও নিজের জাতিকে অবজ্ঞা করি, গালাগাল দেই, নিজের মানুষদের পছন্দ না করে অন্যদের পছন্দ করি। ভুল শুধরানোর চাইতে ভুল ধরায় বেশি গর্ববোধ করি।

যা হোক, আমি আশা করি, মানুষ (আমরা) এই কঠিন অবস্থা থেকে শিক্ষা গ্রহন করবে এবং বৈষম্য ভেঙ্গে এক হবে।

বলাটা সহজই বটে, তাই নয় কি?

Originally Posted: March, 2020. Updated and Added: August, 2020

Comments

Popular posts from this blog

চেষ্টা আর সহযোগিতা একে অন্যের পরিপূরক

"To those who can hear me, I say - do not despair"